নৌকা বাইচ |
আবহমান বাংলার লোক-ঐতিহ্য অত্যন্ত প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ। হাজার বছর থেকে এ জনপদের জীবনপ্রবাহ বয়ে চলেছে সামনের দিকে। বিরামবিহীন এই জীবনযাত্রায় এসেছে অনেক পরিবর্তন বিবর্তন। হারিয়ে যাচ্ছে অনেক কিছু। আবার যোগ হচ্ছে নতুন নতুন উপাদান। এদেশের লোককৃষ্টির একটি অঙ্গ নৌকা বাইচ এমনই হারিয়ে যাচ্ছে। অতীতের মতো নৌকা বাইচ আজকাল আর জমে না। নদনদী আর বিল হাওরের এই দেশ বাংলাদেশ। ছয়টি ঋতুর বৈচিত্র্যে ভরা এখানকার জীবন। প্রকৃতি বছরে ছয়বার রূপ বদলায়। শীত হেমন্তের শুকনো বিল আর নদী নালা বর্ষার জল থই থই করে। দিগন্ত বিস্তৃত হাওর তখন সমুদ্রের রূপ নেয়। চারদিকে শুধু পান আর পানি। হেমন্তে নদী মৃত সর্পের মতো পড়ে থাকে। বুক দিয়ে হেঁটে পার হয়ে যায় মানুষ। আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে। কিন্তু বর্ষায় এই নদীই দু’কূল ছাপিয়ে কলকল ধ্বনি তুলে ছুটে চলে সমুদ্রের দিকে। প্রকৃতি বা পরিবেশের এই দৃশ্য পরিবর্তন প্রভাব ফেলে জনজীবনে। এমনই পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই গড়ে উঠেছে এখানকার সাংস্কৃতিক জীবন। আবহমান বাংলার খেলাধুলা, বিনোদন, আনন্দ উৎসব সবখানেই প্রভাব আছে প্রকৃতির। বর্ষার প্রভাবে যেসব উৎসব এ জনপদে আনন্দ উৎসবে পরিণত হয়- তার মধ্যে নৌকা বাইচ প্রধান। এটি উৎসব এবং সেই সঙ্গে পানিতে একটি খেলাও। বিজ্ঞানের কল্যাণে বিনোদনের অসংখ্য মাধ্যম এখন তৈরি হয়েছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে ছোট হয়ে এসেছে পৃথিবী। দেশে দেশে সম্পর্ক হয়েছে ঘনিষ্ঠতর। খেলাধুলা দেশ থেকে দেশান্তরে পাড়ি দিয়েছে। ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস, গলফ প্রভৃতি এখন আর কোনো বিশেষ দেশের খেলা নয়। কিন্তু অতীতে বিনোদনের মাধ্যম ছিল সীমিত এবং যন্ত্রের প্রভাবমুক্ত। খেলাধুলাও ছিল একান্ত দেশীয়। বাংলার হা-ডু-ডু, গোল্লাছুট, ডাংগুলি, লাঠিখেলা প্রভৃতি স্থলভাগের খেলা ছিল একান্ত নিজস্ব। জলের খেলা বলতে তখন ছিল সাঁতার এবং নৌকা বাইচ। নৌকা বাইচের আমেজ এবং আবেদন অতীতের মতো আজকাল হয়তো এতটা প্রবল নয়। কিন্তু এই যান্ত্রিক যুগেও নৌকা বাইচ একেবারে হারিয়ে যায়নি। অতীতে বিশেষ বিশেষ জাতীয় দিবসে আয়োজন হতো নৌকা বাইচের। আজকাল এ রেওয়াজ নেই। তবে বর্ষায় গ্রামগঞ্জে আজও সাড়া পড়ে যায়। কোনো কোনো স্থানে বিশেষ করে হাওর এবং নদী তীরবর্তী এলাকায় উৎসাহী যুবকরা গঠন করে কমিটি। নির্দিষ্ট দিনে আহবান করে নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা। অতীতে লাউড স্পিকার দিয়ে হাটবাজারে চলত প্রচারণা। আজকাল কেউ কেউ বড় বড় পোষ্টারও ছাপায়। মুখে মুখে গ্রামে গ্রামে নৌকা বাইচের খবর ছড়িয়ে পড়ে। দৌড়ের নৌকাগুলো খাল বা পুকুরে এতদিন হয়তো ডুবিয়ে রাখা ছিল। এগুলো তুলে ঘষে মেজে রঙ চং দেয়া হয়। প্রস্ত্ততি চলতে থাকে। প্রতিযোগিতার পুরস্কার ও আগে ভাগেই ঘোষণা করা হয়। সাধারণত খাসি, নারকেল, শিল্ড ইত্যাদি থাকে পুরস্কার হিসেবে। নৌকা বাইচের জন্যে নির্মিত হয় বিশেষ ধরণের নৌকা। অঞ্চলভেদে এগুলোর আকৃতি বিভিন্ন রকম। সিলেট অঞ্চলে এগুলোকে বলে খেন্না বা দৌড়ের নৌকা। উন্নতমানের হালকা কাঠের তৈরি ছিপছিপে লম্বা গঠন। লম্বা নাকের মতো গলুই। অনেক সময় গলুইতে থাকে কারুকাজ। সমস্ত গলুই হয়তো ময়ুরের প্রতিকৃতি। নৌকায় বাইচাদের বসার জন্যে ১৫ থেকে ২৫টি ডাব বা গোড়া থাকে। দু’জন করে একেকটি গোড়ায় বসেন। প্রতিযোগিতার দিন নৌকার গলুই সাজানো হয়। রঙ দিয়ে ঝকঝকে করে তোলা হায় নৌকা। কান্ডারির বৈঠার অগ্রভাগে পতপত করে ওড়ে রঙিন কাপড়। দাঁড়ি বা মাল্লারা ছোট ছোট বৈঠা হাতে সারিবন্দি হয়ে বসে নৌকায়। বাজনা থাকে সঙ্গে। কাশী, করতাল, মন্দিরার সঙ্গে চড়া গলায় একজন গায়ক ধরেন সারি বা বাইচা গান। বাকি সবাই ধুয়া ধরেন। এ ধরণের প্রতিযোগিতায় গতি এবং কর্ম উদ্যমের জন্য যে গান গীত হয়, তা লোকসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। নৌকা বাইচের গানকে সারিগান বা হাইড় বলা হয়। কয়েকটি নমুনা দেয়া গেল- (১) করিমুন্নেসা গো মনের সাধ পুরাইলায় নি লংলায় থাকইন কটুমিয়া ইটায় করলা বিয়া বড় সাধ হইল মিয়ার লংলা দেখতা গিয়া.... (২) চানমুখে ঝলমল দেখিতে সুন্দর অল্প বয়সে বালি না যাইও নাইওর.... হায়রে তুমি যে যাইবায় নাইওর আমি একাসর নাকের বেসর থইয়া যাও বিছানার উপর.... (৩) ও নাতিন বারই জুয়াপ দে এত রাইতে তোর মন্দিরে ঢোলক বাজায় কে..... (৪) জালুয়ায় পাগল কইলো তোরে বাবনের মাইয়া গো, মাইয়া জালুয়ায় পাগল কইলো তোরে আর দিন জালুয়ায় জাল বাইতো খালে আর বিলে আইজকু জালুয়ায় জাল বায় সানের বান্ধাইল ঘাটে.... সারিগান বা হাইড় ছাদ পেটানোতেও চলে। নৌকা দৌড়ে সর্বত্র পরিচিত একটি গান- সোনার বান্ধাইল নাও পিতলের গোড়ারে পিতলের গোড়া ও....রঙ্গের ঘোড়া দৌড়াইয়া যাও। ...তাইরে নাইরে তাইরে নাইরে নাই ...আরে বন্ধুর দেশে যাইমু আমি বড় তাড়াহুড়া...আরে হৈ হৈ হৈ হৈয়া.....। এসব গানের সুর ছড়িয়ে প্রতিযোগিতার দিন দূরদূরান্ত থেকে নৌকা ছুটে নির্ধারিত নদী বা হাওরের দিকে। ছোট ছোট খাল নালা মুখরিত হয়ে ওঠে বাদ্যের ঝনঝন আর মিলিত কন্ঠের কোরাস গানে। এসব গানে অনেক সময় থাকে কোনো এলাকার বীরত্ব অথবা সুনামের বর্ণনা, থাকে এলাকা বিশেষের দুর্নাম গাথা। বউ ঝিরা উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখে নেয় নৌকার সারি। একেকটি গ্রামের শক্তি এবং উদ্যমের প্রতীক হয়ে ওঠে নৌকা। নদীতে হলে তীরে জমে অসংখ্য লোক। হাওরে হাজার হাজার মানুষ ডিঙি নৌকা নিয়ে জড়ো হয়। বিশাল হাওরে শুধু নৌকা আর নৌকা এবং দর্শনার্থীর ভিড়। উত্তপ্ত করতালি মুখরিত ফুটবল খেলার মাঠের মতো হাওরের বুক জয়ধ্বনিতে ফেটে পড়ে। প্রতিযোগিতা শুরুর আগের দৃশ্যটি অত্যন্ত উপভোগ্য। শক্তি ও নৈপুণ্য প্রদর্শনীর মহড়া এবং নৌকাগুলোর ফেরির দৃশ্য হয় চমৎকার। গান চলছে। বাদ্যযন্ত্র বাজছে। সুঠামদেহী মাল্লারা ধুয়া ধরছে। গানের তালে তালে বৈঠা ঘুরিয়ে পেছন ভাগ ঠুকছে গোড়ায়। পানি উড়ছে ফেনার মতো। চারদিকে চলছে হাততালি। এক সময় শুরু হয় প্রতিযোগিতা। সীমা বেঁধে দেয়া হয়। যে নৌকা সীমা পেরিয়ে যাবে আগে, জয় হবে তার। চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে দর্শকদের মাঝে। শুধু ঝপঝপ বৈঠার শব্দ। আর মারো টান হেইও, আরও জোরে হেইও-সুর। সেই সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রের সপ্তমে ধ্বনি। সব মিলে চরম উত্তেজনাপূর্ণ উপভোগ্য দৃশ্য। এরই নাম নৌকা বাইচ। বাজি ফারসি শব্দ। এর অর্থ খেলা। বাজি শব্দ থেকে বাইচের উৎপত্তি। নৌকা বাইচের প্রচলন সম্পর্কে কয়েকটি মত আছে। ড. ওয়াকিল আহমদ বলেছেন, মধ্যযুগের মুসলমান নবাব সুবেদার ভূস্বামীরা নৌকা বাইচের আয়োজন করতেন। তাদের নৌবাহিনী নৌকা বাইচের উৎস হতে পারে। পূর্ব বঙ্গের ভাটি অঞ্চলে নৌশক্তি রাজ্য রক্ষা ও রাজ্য জয়ের প্রধান উপায় ছিল। বাংলার বারো ভূঁইয়ারা নৌবল নিয়ে মোগলদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। এখন সেদিন নেই। যেটুকু টিকে আছে তা খেলা বা প্রতিযোগিতায়। নৌকা বাইচের প্রতিযোগিতায় জেতার জন্যে প্রতিটি দল তাদের শক্তি ও নৈপুণ্য যথাসাধ্য কাজে লাগায়। সময় বিশেষ কেউ কেউ টুটকা, মন্ত্র টন্ত্রেরও আশ্রয় নেয়। তবু জিত সবার হয় না। কেউ হারে কেউ জিতে। প্রতিযোগিতা শেষ হয়। আবার গান গাইতে গাইতে, বৈঠায় ঝপঝপ শব্দ তোলে, সন্ধ্যার নদীনালা মুখরিত করে নৌকাগুলো ফিরে চলে নিজ নিজ ঘরের দিকে। গ্রামগঞ্জে হাটেবাজারে জয় পরাজয় নিয়ে হয়তো কয়েকদিন চলে তর্কবিতর্ক, আলাপ-আলোচনা। |
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস